এক কথায় বললে, মহান আল্লাহ্‌ আছেন সাত আসমানের উর্ধে আরশের উপরে।

আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন

মুসলিম হতে ৬ টি বিষয়ের উপর ইমান আনতে হয়। অর্থাৎ ঈমানের রুকন হলো ৬টি। সেগুলি হচ্ছে, ১।আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান, ২। তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীর প্রতি ঈমান, ৩। তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, ৪। তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান, ৫। আখেরাতের প্রতি ঈমান এবং ৬। তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান। কুরআনুল কারীম এবং সহীহ হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী উক্ত রুকনসমূহের প্রত্যেকটির প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণ হবে না। 

সুতরাং বুঝায় যাচ্ছে যে আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন তা জানা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর প্রতি যখনই কেউ ইমান আনবে তখন তার জনাতে হবে তার সম্পর্কে তিনি কে, কোথায় থাকেন, কি করেন, কতটা ক্ষমতা বান ইত্যাদি। আজকের এই পোস্টে আমরা শুধু মাত্র আল্লাহ কোথায় থাকেন তা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন এ বিষয়ে অনেক বিভ্রান্ত মতামত মানুষের মাঝে আছে এর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মতামত হলো আল্লাহ সর্বত্র বিরাজ করেন, আল্লাহ হচ্ছেন নিরাকার। তারা মনে করেন, আল্লাহ তার সৃষ্টির মাঝে থাকেন বা এই দুনিয়াতে থাকেন বা মানুষের সাথে সাথে থাকেন। এই চিন্তা মুসলমানদের মাঝে রাখেন সাধারনত সুফীবাদে বিশ্বাসীরা তারা মনে করেন আল্লাহ মানুষের মাঝেই আছেন নাউযুবিল্লাহ

ইবন আরাবি এবং নয় শতকের বিজ্ঞানী জালাল আদ-দিন-সুয়ুতি তাদের মত হচ্ছে – আল্লাহ ছাড়া আসলে আর কিছু নেই। সৃষ্টি জগত কোন আলাদা কিছু নয়। সবকিছুই আল্লাহ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আপনি কেন আশে পাশের কোন কিছুকে উপাসনা করবেন? আল্লাহ তো আপনার, আমার, সবার মধ্যেই আছেন। বাইরের কোন কিছুর উপাসনা করে কি করবেন? তার চেয়ে আপনি নিজেকেই উপাসনা করতে পারেন – কারণ আপনি নিজেই আল্লাহ। আল্লাহর তাঁর রুহের একটি অংশ মানুষের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন, যখন তিনি আদমকে মাটি থেকে তৈরি করেছিলেন। সেই রুহের একটি অংশ এখনও মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। মানুষের কাজ হচ্ছে আল্লাহর আরাধনা করে ধ্যানের উচ্চস্তরে গিয়ে আল্লাহর রুহের সাথে একাত্ত হয়ে যাওয়া। যারা এই উচ্চ পর্যায়ে চলে যেতে পারে তারা তখন অনেক অতীন্দ্রিয় কাজ করতে পারে। তারা মানুষের ভাগ্য বলে দিতে পারে। ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। তাদের তখন আর সাধারণ মানুষের মত নামায পড়ার দরকার হয় না। নাউযুবিল্লাহ

এছাড়াও এই বিশ্বাস রাখে হিন্দুরা। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে তাদের সর্বশক্তিমান, অসীম, অপরিবর্তনীয়, চিরজীবী, সর্বব্যাপী সত্তা হচ্ছে ব্রাহ্মণ, যে হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সকল শক্তি, বস্তু, সময়, স্থান, জ্ঞান এবং মহাবিশ্বের ভিতরে এবং বাইরে যা কিছু আছে তার সবকিছু। তাকে যখন উপাসনা করা দরকার হয়, তখন তারা একটি অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক হাতি – গণেশ মূর্তির প্রতি মনোযোগ দেয়, কারণ তখন ব্রাহ্মণ সেই মূর্তির মধ্যে ঘনীভূত হয়। তারা আসলে গণেশ মূর্তিটাকে পুজা করছে না, কারণ তারা জানে মূর্তিটার কোন ক্ষমতা নেই। বরং মূর্তিটার মধ্যে ঘনীভূত ব্রাহ্মণকে তারা পূজা করছে। এই হল হিন্দুদের ইয়গি বা তাদের জ্ঞানী আলেমদের ধারণা। অবশ্যই সাধারণ হিন্দুদের এত ভালো ধারণা নেই। তারা গণেশ মূর্তিকে পূজা করেই খুশি।

ঠিক একই বিশ্বাস অনেক মুসলিম না বুঝে রেখে থাকেন । অনেকে তাদের বাপ-দাদাদের থেকে শিখেছেন এবং এই সব ভ্রান্ত আকিদার মানুষদের থেকে শিখেছেন। তাহলে সঠিক টা কি? 

সঠিক হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন; (আরশ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির উর্ধ্বে) তিনি সেখানেই থাকেন যেভাবে তাঁর সত্তার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ, কোন জিনিসই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। 

মহান আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা কোথায় থাকেন তা আমার তার কালাম (আল-কুরআন) থেকেই জেনে নেই চলুন। 

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

 اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۟ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّهَارَ یَطۡلُبُهٗ حَثِیۡثًا ۙ وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ وَ النُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَکَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ 

অর্থঃ নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে উঠেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব। (সুরা আরাফ, আয়াত ৫৪)

যেমন তিনি আরো বলেনঃ

 اَللّٰهُ الَّذِیۡ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیۡرِ عَمَدٍ تَرَوۡنَهَا ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ یُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ بِلِقَآءِ رَبِّکُمۡ تُوۡقِنُوۡنَ 

অর্থঃ আল্লাহ, যিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ উঁচু করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে উঠেছেন এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়োজিত করেছেন। এর প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে। তিনি সবকিছু পরিচালনা করেন। আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যাতে তোমাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমরা দৃঢ়বিশ্বাসী হতে পার। (সুরা আর-রাদ, আয়াত ০২)

যেমন তিনি আরো বলেনঃ 

اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی 

অর্থঃ পরম করুণাময় আরশের ওপর উঠেছেন (সুরা ত্বহা, আয়াতঃ ০৫)

 ۣالَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَهُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۚۛ اَلرَّحۡمٰنُ فَسۡـَٔلۡ بِهٖ خَبِیۡرًا

অর্থঃ যিনি আসমান, যমীন ও উভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। পরম করুণাময়। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে যিনি সম্যক অবহিত, তুমি তাকেই জিজ্ঞাসা কর। (সুরা ফুরকান, আয়াতঃ ৫৯)

এরকম আরো বেশ কিছু আয়াত রয়েছে, মোট কথা-

আল্লাহ্ তা'আলা আরশের উপর উঠেছেন বলে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। তিনি কিভাবে আরশে উঠেছেন সেটার ধরণ আমাদের জানা নেই। এটা ঈমান বিল গায়েবের অংশ। 

সুতরাং আমরা আল্লাহর কালাম তথা আল কুরআন থেকে জানলাম আল্লাহ তাআলা আরশে আজিমের উপরে রয়েছেন । এবার আসুন দেখি রাসূল সাঃ ও আমাদের ইমামগন এ বিষয়ে কি বলেছেন?

১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সপ্তম আসমানের উপর উঠানো হয়েছিল, তাঁর রবের সাথে কথোপকথনের জন্য। আর সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। (বুখারী ও মুসলিম)

২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

ألاَ تأمَنُونيِْْ وَأنا أمِينُ مَنْ فيِ السَّمَاء (وهو اللهُ) (ومعني في السَّماء: علي السَّمَاء) (متفق عليه)

তোমরা কি আমাকে আমিন (বিশ্বাসী) বলে স্বীকার কর না? আমি তো ঐ সত্ত্বার নিকট আমিন বলে পরিগণিত যিনি আসমানের উপর আছেন। (আর তিনি হলেন আল্লাহ) (বুখারী ও মুসলিম)।

৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:

ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء (أي هو الله) (الترمذي وقال حسن صحيح)

যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া কর, তবেই যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (তিরমিযী হাসান সহীহ)

৪। অন্য হাদীসে এসেছে:

سأَلَ رَسُولُ الله صلي الله عليه وسلَّمَ جَارِيَةً فَقَالَ لَهَا: أيْنَ اللهَ؟ فَقَالَتْ في السَّماءِ قَالَ مَنْ أنا؟ قَالَتْ أنْتَ رَسٌولُ اللهِ قَالَ: أعْتِقْهَا فإنَّها مُؤْمِنَةً . (مسلم)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাসীকে জিজ্ঞেস করলেন: বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তারপর তিনি বললেন: বলতো আমি কে? সে বলল: আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা। (মুসলিম)।

৫। অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

وَالْعَرْشُ فَوْقَ الْمَاء وَاللهُ فَوْقَ عَرْشِهِ وَهُوَ يَعْلَمُ مَا انتُمْ عَلَيْهِ. (حسن رواه أبو داود)

আরশ পানির উপর আর আল্লাহ আরশের উপর। তৎসত্তেও, তোমরা কি কর বা না কর তিনি তা জ্ঞাত আছেন। (আবু দাউদ হাসান)।

৬।আবু বকর রা. বলেছেন:

ومَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فإنَّ اللهَ فيِ السماء حَيٌّ لا يمُوتُ (رواه الدارمي في الرد غلي الجهمية باسناد صحيح)

যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমানের উপর জীবিত আছেন, কখনোই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন না। (সুনানে দারেমী সহীহ সনদ) জাহমীয়াদের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

৭। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমরা কিভাবে আমাদের রব সম্বন্ধে জানতে পারব? উত্তরে তিনি বলেছেন: তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে আলাদা হয়ে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের জাত আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে। তার এই উপরে থাকা সৃষ্টির সাথে কোন সামঞ্জস্য নেই।

৮। ইমাম আবু হানিফা সহ সকল ইমামগণই এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি (আল্লাহ) আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোন সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।

এছাড়াও আল্লাহ যে আসমানে আছেন তা সুস্থ বুদ্ধি, বিবেক, সমর্থন করে। যদি তিনি সর্বত্রই বিরাজমান হতেন তবে অবশ্যই তিনি আল কুরআনে বলতেন বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তা জানতেন এবং রাসূল সাঃ সাহাবীদের শিক্ষা দিতেন। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তাঁর শ্রবেনর, দেখার ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত।