আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম হয়েছিলো সোমবার দিন প্রথম সকালে বা সুবহে সাদেকের সময়। তার জন্মের মাসটি ছিলো রবিউল আউয়াল মাস এবং ঐ বছরকে ইতিহাসে ফীলের বছর বলা হয়েছে। 

এই পর্যন্ত বেশিরভাগ সীরাত বিশেষজ্ঞ গনই একমত হয়েছেন। তবে ফীলের বছর বলতে কোন সালকে বুঝানো হচ্ছে এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে কারো মতে ইংরেজি ৫৭০ সাল, কারো মতে ৫৭১ সাল । আবার রবিউল আউয়াল মাসের সেই সোমবার কোন তারিখ ছিলো? সবচেয়ে বেশি মতানৈক্য হয়েছে এই পয়েন্টে এসে, 

সীরাত বিদ্বানরা যে সব তারিখ উল্লেখ করেছেন তা হলো রবিউল আউয়াল মাসের ২, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৭, ২২ তারিখ। এছাড়াও কোন মাস তা নিয়েও মতানৈক্য হয়েছে যেমনঃ কোন কোন সীরাহবিদ দের মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসে নয় বরং রমজান মাসে জন্মগ্রহন করেন, আবার কেউ কেউ বলেন সফর মাসে।

এই মতানৈক্য পুর্ণ বিষয়টি সহজ করে আমার পড়াশুনার আলোকে ও রেফারেন্স সহকারে আজকের এই পোস্টি লিখছি ইংশাআল্লাহ। এই পোস্টির মুল উদ্দেশ্য রাসূল সাঃ এর জন্মদিনের ব্যাপারে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি মুমিন ভাইদের সচেতন করা।

মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্মদিন

জন্মদিনঃ সোমবার। তিনি সোমবারে জন্ম গ্রহণ করেন, সোমবারে নবুওয়ত পান এবং সোমবারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আবু কাতাদা আনসারি (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবারে রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন: এ দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে অথবা এ দিনে আমার উপর (অহি) নাযিল হয়েছে।” [সহিহ মুসলিম (১১৬২)]

বছরঃ রাসূল সাঃ এর জন্মের বছরটি ছিলো ফীলের বছর। যেমন, ইমাম ইবনুল কাইয়ূম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: "এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার অভ্যন্তরে হস্তি বাহিনীর বছর জন্ম গ্রহণ করেন।" [যাদুলমা‘আদ, পৃষ্ঠা-১/৭৬]

জন্মতারিখঃ আগেই সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছি যে, রাসূল সাঃ এর জন্ম তারিখ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মতানৈক্য হয়েছে তবে এর মধ্য হতে রবিউল আউয়াল মাসের ৮, ৯, ও ১২ তারিখ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। তাই আমি এই অংশে এই তিনটি তারিখ নিয়ে বর্তমান ও পূর্ববর্তী আলেমদের মতামত উল্লেখ করবো ইংশাআল্লাহ।

রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখঃ 

১। ইবনুল জাওযী রাসূল সাঃ এর জন্ম ৮ রবিউল আউয়াল উল্লেখ করেছেন, (পুরো রেফারেন্সের জন্য সীরাত বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ২০৯ দেখুন)

২। ইবনে কাছীর রাসূল সাঃ এর জন্ম সম্পর্কিত সূদীর্ঘ আলোচনার পর উপসংহারে বর্ণনা করেছেন যে বিশুদ্ধতম মত হলো ৮ রবিউল আউয়াল (ইবনে কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪২-২৪৩)

৩। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারজেমি এ তারিখের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। হাফেজ আবুল খেতাব ইবনে দিহইয়াহ ‘আত-তানবির ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাজির’ গ্রন্থে এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন”।[আস-সিরাতুন নববিয়াহ(১/১৯৯)] 

৪। শায়খ আলবানি এই মতটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।

রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখঃ

১। রাসূল সাঃ এর জন্ম ৯ রবিউল আউয়াল উল্লেখ করেছেন, আর রাহীকুল মাখতুম গ্রন্থে – ছফিউর রহমান মোবারকপুরী

২। সীরাতুল রাসূল সাঃ গ্রন্থে ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ এর রেফারেন্সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জন্ম ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সোমবার ঠিক রাখতে গেলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে ৯ই রবীউল আউয়ালই সঠিক জন্ম তারিখ হয়। 

৩। হিফজুর রহমান সীওয়াহারবী উল্লেখ করেছেন যে, মাহমূদ পাশা ফালাকী কনস্টানটিনোপল এর একজন প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী তিনি তার গবেষণার আলোকে এ কথা প্রমান করতে চেয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর সময় হতে তার সময় পর্যন্ত সবগুলো সূর্য ও চন্দ্রগ্রহনের নিঁখুত হিসাব করলে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল সাঃ ৯ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহন করেছেন। (পুরো রেফারেন্সের জন্য সীরাত বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ২০৯ দেখুন)

৪। শিবলী নুমানী মিসরের খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা ফালাকীর মতে রাসূল মুহাম্মাদ সাঃ জন্মগ্রহন করেছেন ৯ রবিউল আউয়াল ।

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখঃ

১। ইবনে আবু শায়বাহ তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে এ মতটি আফ্‌ফান থেকে, তিনি সাঈদ ইবনে মিনা থেকে, তিনি জাবের ও ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন। তারা উভয়ে বলেছেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তি বাহিনীর বছর, ১২ ই রবিউল আউয়াল, সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন। [আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)]

২। ড. আকরাম জিয়াউল উমরী তার গবেষণায় তিনটি মত ব্যক্ত করে ১২ রবিউল আউয়ালকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। (পুরো রেফারেন্সের জন্য সীরাত বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ২০৮ দেখুন)

পর্যালোচনাঃ 

জ্যোতির্বিজ্ঞানী যারা ৯ রবিউল আউয়ালকে সোমবার প্রমান করে ঐ দিনকেই রাসূল সাঃ জন্মদিন বলেছেন তাদের সকলেই এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ১২ রবিউল আউয়াল যেহেতু সোমবার হতে পারে না তাই এই দিনটি সঠিক নয়। এছাড়াও এই মতে পক্ষে ইবন হাজার আসকালানী, ইবন তায়মিয়া, ইবনুল কায়্যিম, হুমায়দী আরো অনেকে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন। (বিস্তারিত রেফারেন্সের জন্য সীরাত বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ২০৮ দেখুন)

অন্যদিকে রাসূল সাঃ এর জন্মদিন ৮ অথবা ৯ তারিখ নিয়ে যে সন্দেহ তা মুলত ঐ সময়ের আরবি মাস গুলো ২৯ দিনের নাকি ৩০ দিনের ছিলো তা নিয়ে। আলেমদের গবেষণা থেকে এটা বুঝা যায় যে রাসূল সাঃ এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ৮ অথবা ৯ তারিখে হয়েছিলো। তবে ১২ তারিখের ব্যাপারেও আলেমদের বক্তব্য থাকায় এই তারিখ টিকেও ফেলে দেয়া যায়না । 

রসুল সাঃ এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ হবার পক্ষে কারো কারো যুক্তি

যারা মুলত ১২ তারিখকে রাসূল সাঃ এর জন্মদিন হিসাবে ইদে মিল্লাদুন্নবি পালন করে থাকেন তার এই দিনটিকেই তার জন্মদিন মনে করার যে কারন হতে পারে, যেহেতু রাসূল (সাঃ) ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মৃত্যুবরন করেছেন সে হিসাবে জন্ম ও মৃত্যু এই দিন সোমবার ধরে জন্ম তারিখও ১২ই রবিউল আউয়াল হবে ভেবে নিয়েছেন। [যদিও রাসূল সাঃ এর মৃত্যুর তারিখ নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে]

মনের মাঝে প্রশ্ন আসতে পারে কেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর জন্ম তারিখ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ হয়নি?

প্রথমতঃ রাসূল সাঃ যখন জন্ম হয়েছিলো তখন তিনি একজন সাধারন মানুষের মত জন্ম গ্রহন করেছিলেন, কেউ ধারনা করেনি তিনি শেষ নবী হিসাবে জন্ম গ্রহন করেছেন। এজন্য অন্য নবজাতকের জন্মকে আরবদের মাঝে যেভাবে নেয়া হত তার জন্মকেও সেভাবে নেয়া হয়েছিলো। 

দ্বিতীয়তঃ রাসূল সাঃ তার জন্মের পর থেকে নবুয়তের আগ পর্যন্ত কারো সমালোচনায় আসেননি তাকে নিয়ে মানুষের তেমন কোন উদ্বিগ্ন ছিলো না, তাকে সবাই আলআমিন বা বিশ্বাসী বলে ডাকতো এবং স্বাভাবিক মানুষের মত করে নিয়েছিলো। তার ব্যাপারে কেউ তারিখ সংরক্ষনের কথা ভাবেনি ততদিন । 

তৃতীয়তঃ রাসূল সাঃ এর নবুয়তের পর অর্থাৎ তার ৪০ বছর পর যখন তার জন্মতারিখ সংরক্ষন নিয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করছে ততদিনে তার পরিবারে অনেক নিকট আত্মিয় ইন্তেকাল করেছিলে, বিশেষ করে তার মা, দাদা, ও চাচারা । তাই তার জন্ম তারিখ একদম নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা কেউ করেননি। 

চতুর্থতঃ আরবরা দিন তারিখ সাল সংরক্ষণ করতো না কারন এটা তাদের সংষ্কৃতি ছিলো না। তারা কোন ঘটনাকে অপর কোন ঘটনার সময়ের সাথে উল্লেখ করে মনে রাখতেন। যেমন ফীলের বছর রাসূল সাঃ জন্ম হয়েছিলো। বা অমুক যুদ্ধের বছর এই ঘটনাটি ঘটেছিলো এভাবে মনে রাখতো ইত্যাদি।

রাসূল সাঃ এর জন্মদিন বা মিলাদুন্নবী পালনঃ

যেখানে রাসূল সাঃ এর জন্মতারিখ পূর্ববর্তী সকল আলেমদ্বারা সঠিক ভাবে নির্ণয় কার সম্ভব হয়নি সেখানে একটি দিনকে নির্দিষ্ট করা নেহাত আবেগ ছাড়া কিছুই নয়। তাছাড়া রাসূল (সাঃ) বা তার পরিবার, তার সংঙ্গী সাথী তথা সাহবী গন পরবর্তী ঈমাম গন এবং তাদের অনুসারী সালাফ গন কেউই এই দিবস পালন করেননি। তাছাড়া ইসলামে কারো জন্মদিন পালন করা জায়েজ নয় এবং এ বিষয়ে সকল আলেমগন একমত। 

মিলাদুন্নবীর শুরুঃ ক্রুসেড বিজেতা মিসরের সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হিঃ) কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম কারো মতে ৬০৪ হিঃ ও কারো মতে ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান রাসূলের মৃত্যুর ৫৯৩ বা ৬১৪ বছর পরে। এই দিন তারা মীলাদুন্নবী উদযাপনের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হ’তেন। গভর্ণর নিজে তাতে অংশ নিতেন। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (দারুল ফিকর, ১৯৮৬) পৃঃ ১৩/১৩৭।)

ইসলামি শরিয়তে যে কোন নতুন সৃষ্টি বিদাআত, এবং সকল বিদাআত পথভ্রষ্টতা যা রাসূল সাঃ বলেগিয়েছেন, যেমন তিনি বলেনঃ "যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত"। (মিশকাত হা/১৪০)

আল্লাহ তাআলা ধর্মনিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেনঃ যেমন তিনি বলেন, "হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না ..." (সুরা নিসা আয়াত ১৭১)

রাসূল সাঃ বলেনঃ আমার প্রশংসা করতে গিয়ে তোমারা বাড়াবাড়ি করোনা, (বুখারী হা/৩৪৪৫)

সুতরাং এমত অবস্থায় শরিয়তের অনুমোদন ছাড়া শুধুমাত্র আবেগে বশীভূত হয়ে শরিয়তে কোন আমল ও দিবস প্রচার ও পালন করা হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন আমিন।


এই পোস্টি করতে গিয়ে যেখান থেকে পড়াশুনা করেছি 
  1. সীরাত বিশ্বকোষ - ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
  2. আর রাহীকুল মাখতুম গ্রন্থে – ছফিউর রহমান মোবারকপুরী
  3. সীরাতুল রাসূল (সাঃ) - ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
  4. বাংলা হাদিস - https://www.hadithbd.com/
  5. https://islamqa.info/ - শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
  6. Diploma in Islamic Studies (Taibah academy) notes and lectures by D. Monjur e elahi
  7. আত-তাহরিক https://at-tahreek.com/
(এই পোস্টে কোন ভুল ভ্রান্তি প্রকাশ পেলে আমাকে সংশোধন করার অনুরোধ করছি।)