করযে হাসানা

বর্তমান সময়ে সুদের উপরে টাকা নেয়া যতটা সহজ তার থেকে অনেক গুন কঠিন কারো থেকে কর্জে হাসানা নেয়া।

কেন মানুষ মানুষকে বিনা সুদে ঋণ দিতে চায় না? 

এর উত্তরের আমি কয়েকটা কারন উল্লেখ করতে চাই, সেগুলো হলোঃ 

প্রথমত মানুষ হয়ত অন্য মানুষের কাছে তার বিশ্বাসের জায়গাটা নষ্ট করেছে। অহরহই শোনা যায়, মানুষ টাকা ধার নিলে নাকি সময় মত ফেরত দেয় না। আর এটি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, এজন্য বর্তমান সময়ে মানুষ মানুষকে তেমন একটা বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে টাকা পয়সার ক্ষেত্রে তো না। মানুষ ঠিক কবে তাদের এই বিশ্বাসের জায়গাটা অন্য মানুষের কাছে নষ্ট করেছে তা আমার জানা নেই তবে বর্তমান সময়ে আমি এটা দেখতে পাই যে, অনেক পিতা তার অনেক সন্তানকে বিশ্বাস করে না। অনেক সন্তান তার পিতা মাতার থেকে তার সম্পদ লুকিয়ে রাখে ও তার অন্য ভাই-বোনদেরও দিতে চায় না। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে নিজ পরিবারের বাহিরের কাউকে টাকা দিয়ে বিশ্বাস করার বিষয়টা একটু বেশি বেশিই হয়ে যায়। 

দ্বিতীয় যে কারনটি আমার মনে হয় তা হলো, মানুষ ধার নিলে সেই ধার নেয়া টাকার থেকে কিছু বৃদ্ধি করে দেয়া বা উপঢৌকন দেয় না। এটা সম্পূর্ণ জায়েজ যে, কেউ টাকা ধার নেয়ার পর ফেরত দেয়ার সময় নিজের ইচ্ছা মত কিছু বৃদ্ধি করে দেয়া। এই বৃদ্ধি করে দেয়া সুদের সম্পূর্ণ বিপরীত। সুদে টাকা দিলে নির্দিষ্ট হারে টাকা বৃদ্ধি পায়। যেমনঃ কেউ ১০০০ টাকা ১০% সুদে ঋণ প্রদান করলে একবছর পর সে সুদে-আসলে ১১০০ টাকা পাবে। অপর দিকে কেউ যদি ১০০০ টাকা করযে হাসানা প্রদান করে আর একবছর পর সেই ঋণ প্রহন করা ব্যাক্তি যদি ১৫০০ টাকাও ফেরত দেয় তবুও তা জায়েজ, কারন এই অতিরিক্ত টাকার কোন চুক্তি হয়নি এবং এটা অনির্দিষ্ট। আবার এমনটাও হতে পারতো যে, ঋণ নেয়া সেই ব্যাক্তি শুধু ১০০০ হাজার টাকাই ফেরত দিতে পারতো। 

তবে আমি মনে করি কারো থেকে ঋণ নিলে তাকে কিছু হলেও বৃদ্ধি করে দেয়া উচিত। এর কারন দুইটি-

  1. এই ১০০০ টাকা যদি ঋণ প্রদান কারি ব্যাক্তি কোথাও বিনিয়োগ করতো তবে তিনি এর থেকে কিছু লাভ করতে পারতেন, অথচ তিনি আপনাকে দিয়েছেন তাই তাকে খুশি করতে কিছু উপঢৌকন দেয়া যেতেই পারে।
  2. বর্তমান সময়ে টাকার উপরে ইনফ্লেশন রেট বা মুদ্রাস্ফীতি আরোপ হয় অর্থাৎ প্রতিবছর টাকার মান কিছু কিছু করে কমে যায়। আর তাতে ১ বছর পর, আগের বছরের ১০০০ টাকা আর সমান থাকে না। তাই ঋণ প্রদান কারিকে খুশি মনে কিছু টাকা বৃদ্ধি করে দিলে তার সেই লসটা আর হয় না। কারন একবছর পর যদি ১০০০ টাকাই ফেরত দেয়া হয় তবে ঋণ প্রদান কারির (দেশ ভেদে) ২ থেকে ১০% টাকা লস হবে। সহজ ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বুঝতে এই পোস্টটি দেখুন।

তৃতীয় যে কারনটি আমার মনে হয় তা হলো, বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ মানুষ অর্থ মজুদ করার প্রতিযোগিতা করে থাকে। আর এই প্রতিযোগিতা করবেই না বা কেনো? অর্থের উপর ভিত্তি করেই তো একজন মানুষকে মুল্যায়ন করা হয়। আমি জানিনা আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে কি হতো, হয়ত মানুষ তখনও এমনই ছিলো, যার অর্থ যত বেশি তিনি তত বেশি সম্মানিত, ক্ষমতাবান এবং সবার মধ্যমনি। আর তাই এই অর্থ মজুদ করার প্রতিযোগিতায় কেউ কাউকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে চায় না। কারন এতে অনেকে মনে করে ঋণ দিলে তার অর্থের মজুদ কমে যাবে আর অপর জনের বেড়ে যাবে। আবার ঋণ প্রদান করলে যে তো তার টাকা ব্যবহার করে টাকা ইনকাম করবে অথচ তাকে কিছু দিবে না। এর চেয়ে ব্যাংকে রেখে দিলে সুদ পাওয়া যাবে।

আর ঠিক এই কারনে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা এত বেশি। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে কারন ব্যাংক তার টাকা ব্যবহার করলে এর উপর সুদ প্রদান করে, অন্তত মুদ্রাস্ফীতির জন্য যে টাকাটা কমে যেত + ব্যাংক সার্ভিস চার্জ হিসাবে যে টাকা কেটে নিতো তা এডজাস্ট হয়ে যায়। অপর দিকে মানুষ মানুষের থেকে ঋণ না পেয়ে ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয় এবং এই সুদের বোঝা বছরের পর বছর টানতেই থাকে। অথচ দেখেন আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের ভিন্ন কথা বলেছেন-

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, "এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম করয দিবে? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।" [৫৭/২৯]
এই আয়াতের তাফসীরে (কুরতুবী) আল্লাহকে উত্তম করয দেয়াকে করযে হাসানা দেয়া বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কোন কোন তাফসীরে আল্লাহর পথে ব্যায় করাকে উল্লেখ করেছেন। যাইহোক আল্লাহকে তো আর ঋণ দেয়া যায় না কারন তিনি অমুখাপেক্ষী। আমাদের আল্লাহকে প্রয়োজন কিন্তু আল্লাহর আমাদের প্রয়োজন নেই। তাই আল্লাহ তকে করয দেয়া বলতে, যার এখন ঋণ প্রয়োজন তাকে দেয়া বুঝিয়েছেন। আমরা আল্লাহর কাছে যখন কিছু চাই তখন আল্লাহ তাআলা সেই চাওয়াকে পুরন করেন সরাসরি, বা অন্য মানুষের মাধ্যমে। 
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যদি এমন করযে হাসানা প্রদান করি তবে তিনি ঋণ প্রদান করির জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ যদি বৃদ্ধিকরে দেন তবে আর কি লাগে? এর থেকে উত্তম প্রতিদান আর কি হতে পারে? তাই আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, আমাদের যাদের করযে হাসানা প্রদান করার সুযোগ আছে আল্লাহ তাদের করযে হাসানা দেয়ার তৌফিক দান করুন আমিন।