আমি তখনো সালাফী মানহাজ কি এটাই বুঝিনা, মাদরাসা থেকে লেখাপড়া করেছি সেই সুবাধে ইসলাম সম্পর্কে টুকটাক জ্ঞান আছে বলা চলে। সেই সব খন্ড খন্ড জ্ঞান থেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, আমি কি মুসলিম নই? আমি কি আমার রব হিসাবে এক আল্লাহকে মেনে নেইনি? আমি কি রাসূল হিসাবে মুহাম্মাদ সাঃ কে মেনে নেই নি? তাহলে তো আমি মুসলিম; এখন নতুন করে অন্য নাম সালাফী হবার কি দরকার? এটা কি বিভক্তি নয়? এ রকম অনেক প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে থাকলো অবিরত…

salafi manhaj

বলছি আজ থেকে প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর আগের কথা (আমি সঠিক জানিনা ঠিক কখন একটা শুরু হয়েছে) যখন আমি একজন মুসলিম হিসাবে সেই অর্থে কোন সচেতনই ছিলাম না, আরে আমি তো মুসলিম, আলেমরা যা বলে আমি তাই করি। নামাজ পড়ি রোজা রাখি দান সদাকা করি এগুলোই সব। কে যেন একবার বলেছিলো যারা বেশি অত্যাচারের শিকার হয় তারাই সঠিক মুসলিম। এটা ছিলো আমার ভালো মুসলিম হবার সহজ মুলনীতি। এটা আশ্চর্য এক মুলনীতি যা একই সাথে সঠিক ও ভুল। যাই হোক সেই সময়টাতে আমার কখনো মনে হয়নি কোন আলেম ভুল পরামর্শ দিতে পারে অন্তত আমি যাদের সঠিক বলে মনে করি তাদের ক্ষেত্রে তো না। কোন আলেমের কথাকে বা ব্যাখ্যাকে পরখ করে দেখতে হবে তিনি সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিনা এটা মাথায় ধরতো না। আরে আলেম মানে তো জ্ঞানী; ওরা আমাদের থেকে জ্ঞানী; আমরা তাদের মত বুঝি নাকি। একজন আলেম বললো আল্লাহর হাত বলতে তার শক্তি, আচ্ছা ঠিক আছে শক্তি। আল্লাহর আবার হাত হয় কি করে? মাথায় ঢুকে না। আমার আর পরখ করার কি আছে? বিষয়টা তো মাথায় ঢুকে না। এভাবেই চলতো দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়া। এই পথে যখন শিরক, বিদাআত, ইসলামী আকীদাহ এই কি ওয়ার্ড গুলোর সাথে পরিচিত হই তখন পড়ে যাই এক মহা ঘুর্ণিপাকে। কোন দিকে যাই কি করি, কাকে ভুল বলি আর কাকে সঠিক বলি? ইমামে আজম আবু হানিফা রঃ আল ফিকহুল আকবার নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন, আমি কখনো কল্পনাও করিনি এটা ইসলামী আকীদার বই। আমি ভাবতাম এটা ফিকহের বই; যেখানে লেখা আছে শরিয়তের মাসআলা বা নিয়মকানুন। যখন জানলাম এটা মাসআলার বই না এটা এমন এক ফিকহ(জ্ঞান) যা আকবার(সবচেয়ে বড়); মানে তিনি সবচেয়ে বড় জ্ঞানের বিষয়ে তার সবচেয়ে মুল্যবান বইটি রচনা করে গেছেন আর সেটা হলো ইসলামী আকীদার বিষয়ে। তখন কিছুটা আগ্রহ হলো একটু সামনে এগিয়ে দেখি, সবকিছুর পাশাপাশি একটু পড়শুনা করে দেখি, আল্লাহ চাইলে সহজ করে দিবেন এই আশা ছিলো।

প্রথমে সমস্যা ছিলো আলেমদের মধ্যে বিভক্তি, একেক আলেমের একেক মত। কারো সাথে কারো যেন মিল হতে চায়না, যে যখন মাইক পেয়ে যান তখন এক ঘা মেরে দেন বিরোধী কাউকে। আর আমরাও বিভ্রান্ত হয়ে যাই, আরে ভাই কে সঠিক? কাকে মানবো? এর সাথে যুক্ত হলো যদি আমার পছন্দের আলেমদের কথা গুলোই ভুল হয় তখন কি হবে? আমি তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো।

আবার সাহসও হলো, এত ভয় কিসের সত্যকে মেনে নিতে হলে হিম্মত থাকতে হয়, সত্য এমন এক বিষয় যেখানে গোটা দুনিয়া এক পাশে গেলে সত্য একাই এক পাশে দাড়িয়ে থাকবে; বিব্রত বোধ করবে না। শুরু করলাম সেই প্রথম থেকে।

আমরা মুসলিম কারন আমরা এক আল্লাহকে রব হিসাবে মানি, আল্লাহ তার সকল হুকুম আহকাম রাসূল সাঃ এর মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। রাসূল সাঃ সেই সব হুকুম আহকাম নিজে ব্যাক্তি জীবনে পালন করেছেন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পালন করে দেখিয়েছেন এবং সাহবীদের শিখিয়েছেন এবং তাদের ভুল হলে সংশোধন করে দিয়েছেন।

কিন্তু আমার যেই সময়ে বসবাস করছি সেই সময়ে তো রাসূল সাঃ নেই এমনকি সাহবায় কেরামগনও নেই তাহলে আমাদের দ্বীনের বিষয় গুলো কে শিখিয়ে দিবেন? সত্যি কথা বলতে এমন একটি স্টেজে এসে সবাই ভেবে নেয় আরে আমাদের মাঝে যেই আলেম বেশি শিক্ষিত তাকে মেনে চলবো। কেউ ভাবেন যিনি প্রবীণ তাকে মেনে চলবো। না এভাবে হয়না কারন কোন মানুষ ভুলের উর্ধে নয় প্রতিটি মানুষই ভুল করেন। আমাদের যদি এমন কাউকে মেনে নিতে হয় তবে আমরা শুধু মুহাম্মাদ সাঃ কেই মেনে নিতে পারবো কারন তাকে দ্বীন শিখিয়েছেন সয়ং আল্লাহ তাআলা এবং তার ভুল সংশোধনও করে দিয়েছেন সয়ং আল্লাহ তাআলা। তাহলে এই যুগে থেকে কিভাবে রাসূল সাঃ কে সরাসরি মানা যায়?

এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজাই ছিলো আমার মুল লক্ষ্য আমি বুঝলাম, ঠিক এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর বের করতে পারলেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক ইসলামকে মানা সহজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আজ যে ব্যাখ্যাটি কোন আলেম দিচ্ছেন সেই ব্যাখ্যাটিই যদি তার আগেকার যুগের আলেমের সাথে মিলে যায় অর্থাৎ আমাদের ঈমামগন (যেমনঃ আবু হানিফা, শাফেই, মালেকি, হাম্মলি, ইবনে তাইমিয়া ইত্যাদি) এবং তাদের সাথে তাদের আগেকার তাবে-তাবঈ আলেমগনের সাথে, এবং তার আগেকার তাবেঈগনের সাথে এবং এইভাবে তাদেরটা সাহাবিদের সাথে এবং সর্বোশেষে গিয়ে সরাসরি রাসূল সাঃ এর সাথে মিলে যায়, তাহলে তো একদম সঠিক ব্যাখ্যাটা পাওয়া যাবে।

অর্থাৎ আজ যদি কোন আলেম বললেন, [আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশে প্রথম আসমানে নেমে আসেন ] ঠিক এই কথাটাই হুবহু সাহাবিগন রাসূল সাঃ থেকে বলতে শুনেছেন বলে প্রমানিত হয় তখন কি আর এই বাক্যটি নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হবে? না কখনই সন্দেহ হবে না।

এর পর থেকে আমি সংশয় যুক্ত বিষয়গুলোর বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, যেমনঃ কোন কোন আলেম বলেন রাসূল সাঃ নুরের তৈরি। তখন আমি প্রশ্ন করি এটা আপনারা কোথায় পেয়েছেন এটা কি আমাদের ইমামগন বলেছেন? তার আগের তাবে-তাবঈগন? রাসূল সাঃ নুরের তৈরি এই ব্যাপারে সাহাবীগন কি বলেছেন? কারন তারাতো সরাসরি রাসূল সাঃ কে দেখেছেন। আচ্ছা রাসূল সাঃ নিজে নিজের সম্পর্কে কি বলেছেন? তিনি কি নিজেকে নুরের তৈরি বলে দাবি করেছেন নাকি আপনারা আপনাদের কল্পনা শক্তদিয়ে ভেবে বলছেন? সর্বোশেষে আচ্ছা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তো নিজেই রাসূল সাঃ কে সৃষ্টি করেছেন তিনি কি বলেছেন? এই সব গুলোর উত্তর পাওয়া গেলে সঠিক টা পাওয়া যাবে। এই গুলোর যে কোন একটিকে নিয়ে সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন। ধরুন আমরা শুধু কুরাআনের একটি আয়াত নিলাম এবং এর ব্যাখ্যা করলাম আর আমাদের অনুবাদ মতে মনে হলো রাসূল সাঃ বুঝি নুরের তৈরি, কিন্তু এটা তো আমাদের অনুবাদ/ব্যাখ্যা, এই আয়াত সম্পর্কে সরাসরি রাসূল সাঃ এর ব্যাখ্যা কি? কারন তার উপর এই কিতাব নাযিল করা হয়েছে। ধরুন পাওয়া গেলো না, তাহলে আমরা খুঁজবো এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবিগন কি বলেছেন? কারন সাহাবিগন যখন কোন কিছু বুঝতেন না তখন সরাসরি রাসূল সাঃ এর থেকে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নিতেন। ধরুন এবারও পাওয়া গেলো না, তবে আমরা সাহাবীদের ছাত্র এমন তাবঈগনের ব্যাখ্যা চাইবো কারন তারা সরাসরি সাহাবীদের থেকে জ্ঞান নিয়েছেন আর সাহাবিগন ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন যখন কুরআন নাযিল হতো। বিশ্বাস করুন আকীদা, শরিয়তের বিষয়ে এতদুর পরখ করে আসতে হয়না। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো এতটাই স্পষ্ট যে মোটামুটি সাহাবায় কেরামদের সময় পর্যন্ত খুঁজলেই সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

আর এইভাবে বর্তমান আলেমদের ব্যাখ্যার উপরে < ইমামগনের ব্যাখ্যা, তাদের উপরে < তাবে-তাবঈ ও তাবেঈগনের ব্যাখ্যা ও তার উপরে < সাহাবীগনের ব্যাখ্যা ও এর উপরে < রাসূল সাঃ এর দেয়া ব্যাখ্যাকে প্রাধন্য দেয়ার যে পদ্ধতি এটাই হলো সালাফী মানহাজ বা ম্যাথোডলজি বা পদ্ধতি।

এটি মুলত কোন দলের নাম নয় বরং কিভাবে শরিয়তের কোন সংশয়যুক্ত বিষয়ের সমাধান করা হবে সেই নীতি। এই নীতির আলোকে কোন ব্যাক্তিকে একক ভাবে অন্ধবিশ্বাস করা হবে না (শুধুমাত্র রাসূল সাঃ ছাড়া) বাকি সকল ক্ষেত্রে তাদের ব্যাখ্যাটার সত্যতা পরখ করে দেখা হবে। অন্য আলেমরা কি বলছেন, তার সিনিয়ররা কি বলছেন, এভাবে রাসূল সাঃ পর্যন্ত।

কুরাআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা বা তাফসির এই যুগের কোন আলেমের থেকে নেয়ার থেকে সরাসরি সাহাবায়কেরাম যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাঃ এর থেকে নেয়াকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হবে। কারন কুরআন যে সময়ে যে পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছে সেটা বিবেচনা করে এই সময়ে এর সঠিক ব্যাখ্যা করা পছিবল নয়। শুধু মাত্র ডিকশনারি দেখে এর অনুবাদ করাও হবে পায়ে কুড়াল মারার মত।

একই ভাবে ইসলামের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোন একক আলেমকে সঠিক ধরে সবক্ষেত্রে অনুসরন না করা। যেমন আমাদের দেশে হানাফি মাযহাবের মানুষের সংখ্যা বেশি। নিঃন্দেহে ইমাম আবু হানিফ সকল ইমামের বড় ইমাম তাই বলে কি আমরা ধরে নিবো সকল মাসআলার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা সঠিক? না কখনই না বরং আমরা তার কথাকে তার ব্যাখ্যাকে সাহাবিদের সাথে মিলিয়ে দেখবো যদি মিলে যায় গ্রহন করবো আর যদি না মিলে যায় তবে তা বাদ দিবো এবং এর বিপরিতে সাহাবায়কেরামের ব্যাখ্যা গ্রহন করবো।

একই ভাবে বর্তমান সময়ে আমরা যাদের সালাফী আলেম মনে করছি তাদের কথাও পরখ করে দেখবো তিনি কি সঠিক সোর্স থেকে কথা বলছেন নাকি নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা চালিয়ে দিচ্ছেন? যদি বর্তমান সময়ের আলেমদের কথা সাহাবায়কেরামদের সাথে মিলে যায় তবে মেনে নিবো না মিলে গেলে মেনে নিবো না। এটাই হলো সালাফী মানহাজের মুলনীতি। তাই আমি নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে না দিয়ে সত্যকে যাচাই করার দলে ভিড়িয়ে দিলাম, যারা বুঝে শুনে দেখে গ্রহন করে। ধর্ম(শরিয়ত) মানার ক্ষেত্রে ওহীর বিপরীতে আর কারো ব্যাখ্যার স্থান নেই। এজন্যই আমি সালাফী মানহাজকে অনুসরন করি। আলহামদুলিল্লাহ।